X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাতাস’ বিক্রির কথা

ইকরাম কবীর
১৮ মে ২০১৭, ১৪:৪৭আপডেট : ১৮ মে ২০১৭, ১৪:৪৮

ইকরাম কবীর অনেক মানুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, মোবাইল কোম্পানিগুলো ‘বাতাস’ বিক্রি করে দেশের সব অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যেমন অবলীলায় এ কথাটি বলে ফেলা যায়, এই ‘বাতাস’ কী করে তৈরি হয়, তা বুঝে কথা বলা ততটাই জটিল।
একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য এমনটা ভেবে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক। আমরা যখন এক বোতল পানি কিনি অথবা এক বোতল টমেটো কেচাপ কিনি,  তখন কিন্তু একটুও ভাবি না যে আরে পানি তো, আমাদের দেশে হাটে-মাঠে-ঘাটেই এসব পাওয়া যায়! এ জন্য আবার দোকান থেকে বোতল কিনতে হবে কেন? আমরা এও ভাবি না, এক কিলোগ্রাম টমেটো কিনে এনে মসলা মাখিয়ে চুলার ওপর জ্বাল দিলেই তো কেচাপ তৈরি হয়ে যাবে!
এর কারণ, আমার মনে হয় পানি ও কেচাপ বোতলে করে কিনে পান করা এবং বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে খাওয়া আমাদের জীবনযাত্রায় এমনভাবে মিশে গেছে যে, এগুলোর অনুপস্থিতি আমাদের পীড়া দেয়। আবার এক বোতল পানি ও কেচাপ যখন কিনে হাতে নিয়ে ধরতে পারি, তখন আমার সঙ্গে এই বোতলগুলোর একটি স্পর্শজনিত যোগাযোগ তৈরি হয়। অবচেতন মনেই বুঝতে পারি, আমি পানি নামের একটি সম্পদের মালিক।
অন্যদিকে যে ‘বাতাস’ আমরা মোবাইল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পাই, তা হাতে ধরতে পারি না বলে আমরা বুঝি না যে এই ‘বাতাস’ কিনে কেমন সম্পদের মালিক হলাম। মোবাইল হ্যান্ডসেট নামে যে যন্ত্রটির মাধ্যমে এই ‘বাতাস’ আমাদের কাছে পৌঁছে, তা হাতে ধরে নিজের মনে করতে পারি বলেই হয়তো এই যন্ত্রটিকেই বেশি আপন মনে হয়।
এ কথাগুলো বলছি তার কারণ, আমার মনে হয়, এই ‘বাতাস’ ব্যবহারকারীরা কী ব্যবহার করছেন, তা নিয়ে তেমনটা ভাবেননি অথবা মোবাইল কোম্পানিগুলোই তাদের ব্যবসার পুরো প্রক্রিয়াটি কাউকে বোঝাতে পারেননি। আমরা অন্যান্য ব্যবসা যেমন ব্যাংকিং, খাবার, সিমেন্ট, তৈজসপত্র যেমন বুঝি, এই ‘বাতাস ব্যবসা’ বোধ হয় তেমন বুঝি না। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, সারাদেশে হাজার হাজার টাওয়ার বসিয়ে, হাজার হাজার মানুষের চব্বিশ ঘণ্টা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমের মাধ্যমে, প্রতি এক শ টাকায় সরকারকে সাতচল্লিশ টাকা দিয়ে যে ‘বাতাস’ মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার যজ্ঞ এই কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে তার চিন্তা বোধ হয় এই ‘বাতাসের’ মাধ্যমে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা শেষ হয়ে গেলেই আমাদের মাথা থেকে উবে যায়।

বিদেশে টাকা পাঠিয়ে দেয়? বিদেশি বা মাল্টিন্যাশনাল কোনও কোম্পানি দেয় না? ব্যাংক, বীমা, সিমেন্ট, টুথপেস্ট, শিশু-খাবার থেকে শুরু করে সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিই এদেশে বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে মুনাফা লাভের আশায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো কি ব্যবসা করে মুনাফা করতে পারছে? একটি ছাড়া আর কেউই পারছে না। তাহলে টাকা পাঠাবে  কোথা থেকে? এ প্রশ্নটি সবার কাছে রইলো ভেবে দেখার জন্য।

তবে আমি আজ এই কোম্পানিগুলোর সাফাই গাইতে বসিনি। মোবাইল  কোম্পানিগুলো বহু পথ পাড়ি দেওয়ার পর তাদের ব্যবসা ভবিষ্যতে কোনদিকে  যেতে পারে, তার সামান্য একটু ধারণা দিতে চাই। একইসঙ্গে আমি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই যে, সরকার যদি ১৯৯৬ সালে সারাবিশ্বে কী হচ্ছে, তা লক্ষ করে এই খাতের দুয়ার খুলে না দিতো, তাহলে বোধ হয় এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সারাদেশে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলার সুযোগ এই  কোম্পানিগুলো পেত না।

হ্যাঁ, একেবারে প্রথম দিকে হয়তো মোবাইলে কথা বলা সবার জন্য সহজলভ্য ছিল না। তবে আমাদের সরকার ও এই কোম্পানিগুলোর চেষ্টায় এখন যেকোনও শ্রেণির মানুষের পক্ষে মোবাইল ব্যবহার করা সম্ভব। এই অঞ্চলে আমাদের দেশেই এই ‘বাতাস’ ব্যবহারের মূল্য সবচেয়ে কম। তবে এই ‘বাতাস’ সরকারের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে চড়ামূল্যে যা অন্যান্য দেশে অনেক কম।

আমরা কি মোবাইলে শুধুই কথা বলেছি? ইন্টারনেট ব্যবহার করেছি? এই  প্রযুক্তি আমাদের ব্যবসায় ব্যবহার করেছি, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে ব্যবহার করেছি, বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে ব্যবহার করেছি, অর্থ আদান-প্রদান করতে ব্যবহার করেছি। একটা সময় ছিল আমরা মোবাইল ফোনে শুধুই কথা বলতাম। তারপর মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এলো। ফোন ব্যবহার করেই আমরা পত্র-পত্রিকা পড়া থেকে শুরু করে শেয়ার বাজারের খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করলাম। এখন এই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই মোবাইল ফোনসেটে চলছে পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা, বাস-ট্রেনের টিকিট কাটা, সিনেমা দেখা ও আরও অনেক কিছু।

ইন্টারনেটের এই ব্যবহার আরও বাড়বে এবং আমাদের জীবনযাত্রা এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাবে। সময়টা আসছে। আমি বলব, সময়টা চলেই এসেছে। বিশ্বের দেশে-দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রযুক্তি, বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাপন।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন অর্থ লেনদেনে, কেনাকাটায়, একে অন্যের সঙ্গে  যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু যে সময়টার কথা বলছি তা হলো ‘ইন্টারনেট অব থিংস’। ভাবছেন ‘থিংস’ আবার কী!  থিংস হচ্ছে ‘জিনিস’! আপনার প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিস। লাইট-ফ্যানের সুইচ, টেলিভিশন,  ফ্রিজ, গাড়ির টায়ার, আপনার গাড়ি, আপনার রিকশা, চায়ের কাপ, পায়েসের বাটি এমন অনেক কিছু।

ভাবুন তো একবার, আপনি আপনার অফিসের টেবিলে বসে আপনার বাড়ির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। দিন শেষে বাড়িতে আপনি কী চান,  তা গোছাচ্ছেন। আপনার এয়ারকন্ডিশন ঠিক আছে কিনা, ফ্রিজে ডিম ক’টি আছে, আপনার বাড়িওয়ালা প্রধান ফটক বন্ধ করেছেন, না করেননি, ঘরে কতটুকু ময়লা জমেছে, তাও দেখছেন।

বাড়ি এলেন। গোসল করলেন। খাবার তৈরি করলেন। কিন্তু আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই। তিনি কাজে গেছেন অন্য শহরে বা অন্য দেশে। আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা হাতের টেলিফোনটির সামনে বসে তার সঙ্গে কথা বললেন। এরপর আপনি শুভরাত্রি বলে ঘুমিয়ে গেলেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে পারেননি? চিন্তা নেই, ‘বাতাসেই’ রেকর্ড করা আছে ভাষণটি; আপনি শুধু কানেক্ট করেই দেখে নিতে পারবেন। শুধু ভাষণ নয়, এমন সব কিছুই থাকবে আপনার হাতের মুঠোয়।

বাড়ি থেকে সকালে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, দরজা আটকে দিতে ভুলে গেলেন। তাহলে? অফিসে গিয়ে কি এ ব্যপারে কিছু করা সম্ভব? অবশ্যই! আপনি তাও করলেন। অফিসে বসেই দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। অফিসেও আপনার যাওয়া লাগবে না। আপনার কাজে সাহায্য করার জন্য সেখানে আপনি যা ব্যবহার করেন, সেসব আপনার বাড়িতেই থাকবে। বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করবেন। বাড়ি থেকেই হয়তো বেরুতে হবে না। শুধু বেরুতে হবে পার্কে আপনার শরীর ঠিক রাখার জন্য ব্যায়াম করতে।

বাড়ি ফিরছেন অফিস সেরে। গাড়ি চালাচ্ছেন। হঠাৎ আপনার গাড়ি তার নিজের সমস্যার কথা বলা শুরু করল। এক পর্যায় গাড়িটি বলল, সে আর চলতে পারছে না; ইঞ্জিনে সমস্যা হচ্ছে। আপনি গাড়ি থেকে নেমে তাকে বললেন রাস্তার পাশে নিজেকে পার্ক করে বসে থাকতে। সে তাই করলো। আপনি একটি ট্যাক্সি ডাকলেন যার কোনও ড্রাইভার নেই। সেটা চেপেই বাড়ি ফিরলেন। ওদিকে গাড়ি কোম্পানির কর্মীরা গিয়ে আপনার নিজের গাড়ির সমস্যা মেরামত করতে থাকলো। আপনার গাড়ির সমস্যা হলে গাড়ি কোম্পানি তা নিমেষেই বুঝে যাবে এবং প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নেবে। এখনই তো আমরা ট্যাক্সি ডাকছি ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

অদূর ভবিষ্যতে এই জীবনযাত্রার সহযোগী হতে যাচ্ছে, এখন যাদের আমরা টেলিকম অপারেটর বলি। শিগগিরই  দেখবেন, এই কোম্পানিগুলো ও টেলিকম কোম্পানি থাকবে না। হয়ে যাবে ডিজিটাল কোম্পানি, এগিয়ে নেবে আমাদের ভবিষ্যতের চাহিদাগুলোকে। আমাদের শহরগুলো ও শহরে বসবাস করতে আমরা যেসব জিনিস ব্যবহার করি, সব কানেক্টেড হয়ে যাবে। আমাদের গ্রামগুলো বদলে যাবে; গ্রামে বসবাস করতে আমরা যেসব জিনিস ব্যবহার করি, সব কানেক্টেড হয়ে যাবে।

আমরা এগোচ্ছি এমনই একটি কানেক্টেড ভবিষ্যতের দিকে। আমাদের ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন করবে এই ডিজিটাল  কোম্পানিগুলো। এই ভবিষ্যৎ বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে ইন্টারনেট এবং এই ইন্টারনেট সহজলভ্য ও দ্রুতগতি করার জন্য প্রয়োজন হবে সেই ‘বাতাস’।

এই বাতাসের অন্য নাম ‘তরঙ্গ’।

লেখক : গল্পকার

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
টাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগটাইব্রেকারে ম্যানসিটির শিরোপা স্বপ্ন ভাঙলো রিয়াল
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
গলায় কই মাছ আটকে কৃষকের মৃত্যু
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কোন পদে লড়ছেন কে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ