X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশেষ বিবেচনায় ‘শিশুবিয়ে’ বৈধতার আইন!

আমিনুল ইসলাম সুজন
০২ মার্চ ২০১৭, ১৫:৩১আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৭, ১৫:৪৪

আমিনুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ পাস করেছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এমপি’র প্রস্তাবানুসারে কণ্ঠভোটে এ আইন পাস হয়। সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এ আইন পাস না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। সরকার বা সরকারি দল যে কোনও আইনই সংসদে পাস করতে পারে। একদিক থেকে আইনটি ছিল বহুল প্রত্যাশিত, অন্যদিকে বহুল বিতর্কিত। অনেক বছর যাবত আইনটি প্রণয়ন প্রক্রিয়া ঝুলে ছিল। মূলত বাল্যবিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যেই এ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু পাস হওয়া আইনটিতে বাল্যবিয়ে বিশেষ বিবেচনায় উন্মুক্ত করা হয়। ফলে আইনের শিরোনাম ও উদ্দেশ্যে প্রশ্নবিদ্ধ।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের জন্য যখন আইন হয়, যে আইন প্রতিপালন করবে রাষ্ট্রের নাগরিক- তখন যে কোনও আইন প্রণয়নে মানুষের মতামত গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কোনও আইন করতে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মতামত নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তির মতামত গ্রহণ করাই যৌক্তিক। শিশুবিয়ে বন্ধের এ আইন প্রণয়নে বাংলাদেশের সব বেসরকারি সংগঠন সম্মিলিতভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর ও ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ করার দাবি জানিয়েছিল। যে বিধান পূর্ববর্তী আইন, অর্থাৎ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯-এও ছিল।
কিন্তু নতুন পাস হওয়া আইনটিতে বিশেষ বিধান যুক্ত করে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে। যে কোনও বিবেচনাতেই শিশুবিয়ে বৈধ করা অনুচিত। বিশেষ বিবেচনার এ ধারাটি বাতিলের দাবি জোরালো ছিল। যদিও বিশেষ বিবেচনার বিষয়টি বিধিমালায় ব্যাখ্যা করা হবে বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এ ধারাটি মানবাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। এছাড়া জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদ পরিপন্থী।
জাতিসংঘের সর্বজনীন শিশু অধিকার সনদে বলা হয়, ‘১৮ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু’। ১৮ বছর পর্যন্ত যে কোনও শিশুর বাড়ন্ত বয়স, তাই কন্যাশিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হন না। এ অবস্থায় আইন বিশেষ বিবেচনার বিধান যুক্ত করে 'শিশুবিয়ে'কে বৈধতা দিল। শিশুবিয়ের প্রধান কারণ দারিদ্র। কারণ, শিশুবিয়ের ৮০ ভাগই দরিদ্র পরিবারে ঘটছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে। কিন্তু সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। এজন্য অতিদরিদ্র সংখ্যা কমিয়ে আনতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

জাতিসংঘের শিশু উন্নয়ন তহবিল (ইউনিসেফ) এর গত বছরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩৯ লাখ ৪১ হাজার কন্যাশিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে। ইউনিসেফের আরেক গবেষণায় বলা হয়, বাল্যবিবাহের ফলে মাত্র ৫ শতাংশ কন্যাশিশুর লেখাপড়া অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ শিশুবিয়ের শিকার ৯৫% শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। আর শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার। এছাড়া শিশুবিয়ের ফলে ১৮ বছরে আগেই অনেকে মা হয়ে পড়ে। যে শিশু নিজেরই বাড়ন্ত বয়স, সে শিশু যখন গর্ভবতী হয়, তখন মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দেয়। রাষ্ট্রতো শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধীদের দায় ও দায়িত্ব নেয় না। তাইলে রাষ্ট্র কেন প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের জন্য দায়ী শিশুবিয়েকে বৈধতা দেবে?

গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারেই শিশু বিয়ের প্রবণতা বেশি। সে পরিবারে গর্ভবতী শিশু নিজের যেমন প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে পারে না, তেমনি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। অজ্ঞতা ও অপরিণত শারীরিক গড়নের কারণে কিশোরী মায়েদের মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। যে কারণে কিশোরী মাতা ও সন্তানদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী নারীদের তুলনায় ১৮ বছর বয়সের প্রসূতিদের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ৫ গুণ বেশি।

অল্প বয়সী মায়েদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- ‘রক্তে বিষক্রিয়া, গর্ভপাত এবং অপরিণত প্রসবনালীর কারণে বাধাগ্রস্ত প্রসব। বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে মাতৃত্ব গ্রহণের ফলে মেয়েদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের সামর্থ্য কমিয়ে দেয়। কিশোরী মায়ের নিজের বৃদ্ধির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন ও তেমনি গর্ভের সন্তানের জন্যও খাদ্য প্রয়োজন- যা তারা পায় না।

জাতিসংঘের শিশু উন্নয়ন তহবিল (ইউনিসেফ) এর ২০১৬ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে যে কয়টি দেশে বাল্যবিয়ে বেশি হয়, বাংলাদেশ তার মধ্যে পঞ্চম। এশিয়ার কোনও দেশেই বাংলাদেশের মতো শিশুবিয়ের প্রকোপ নেই। অথচ নেপাল, ভুটানসহ অনেক দেশ অর্থনৈতিক সূচক ও উন্নয়ন মানদণ্ডে বাংলাদেশের চাইতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দুঃখজনক হলো, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, মালাউ, নিকারাগুয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, ক্যামেরুন-এর দরিদ্র দেশগুলোতেও বাল্যবিয়ের হার বাংলাদেশের চাইতে কম। বাংলাদেশে ৫২ভাগ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়, এর বড় অংশ ১৫ বছরের মধ্যেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

বাল্যবিয়ে, শিশু বয়সে গর্ভধারণ, শিশুমৃত্যুর হার ও স্কুল থেকে কন্যাশিশুদের ঝরে পড়াসহ পাঁচটি বিষয়ে প্রণীত গার্লস অপারচুনিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশের কন্যাশিশুর অবস্থান খুবই নাজুক। ১৪৪ দেশের ওপর করা এ প্রতিবেদেন বাংলাদেশের অবস্থান ১১১।

নতুন আইন পাস হওয়ার ফলে ব্রিটিশ শাসনামলের ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯’ বহিত হলো। কিন্তু গতকালকের আইন পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত আগের আইনটিই প্রযোজ্য, যেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯২৯ সালের ওই আইনের ধারা ২’এ বলা হয়েছে, ‘নাবালক ও অপরিণত বলতে তাকে বুঝাবে যে ছেলের বয়স ২১ বছরের কম ও যে মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম। সম্পর্ক স্থাপনকারী যে কোনও একপক্ষ নাবালক হলে সে বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয়।’

যেখানে এ ধরনের বিয়ে আয়োজনকারী (অভিভাবক ও ঘটক) ও পরিচালনাকারীদের (কাজী) কঠোর শাস্তির বিধান ছিল।

কিন্তু নতুন আইনে বিশেষ বিবেচনায় শিশু বিয়ের অনুমতি থাকায় এ আইনকে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বলার যুক্তি থাকে না। বাংলাদেশে যেসব কারণে শিশু বিয়ে হয়, এর মধ্যে দারিদ্র এবং কন্যাশিশুর সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে নিরাপত্তার অভাব প্রধান কারণ। পাশাপাশি কম বয়সে বিয়ে হলে যৌতুক কম দিতে হয়- এ ধরনের নেতিবাচক সামাজিক ব্যবস্থা, বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা- ইত্যাদিও বড় কারণ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। মূলত এসব কারণেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অধিকাংশ পিতামাতা কন্যাশিশুর বিয়েতে মত দেন বা দিতে বাধ্য হন। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্তি ও কন্যাশিশু পরিবারের চক্ষুলজ্জা থেকে বাঁচার আশায়ও শিশুবিয়ে দেওয়া হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই প্রেমের কারণে গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা ঘটে।

প্রসঙ্গত, ৫% এর কম ক্ষেত্রে প্রেমজনিত বিয়ে ১৮ বছরের আগে ঘটতো। কিন্তু ৮০% শিশুবিয়ের জন্য দারিদ্র ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব দায়ী।

আইনে বিশেষ বিবেচনায় শিশুবিয়ের বৈধতা দেওয়ার পরিবর্তে বিশেষ বিবেচনার ক্ষেত্র যেন তৈরি না হয়, সে রকম বিধান রাখা জরুরি ছিল। সেজন্য আইনি কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি ছিল। শিশুবিয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেয় অভিভাবক। তাই অভিভাবকদের শিশুবিয়ে বন্ধে তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি।

শিশুবিয়ের এ বিধান রেখে আইন পাস হওয়ায় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথ সঙ্কুচিত করবে। নারী ও শিশু উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা, নারীর অগ্রগতি ও মানবাধিকার বিপর্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। তাই বিশেষ বিবেচনার এ বিধানটি বাতিল করা দরকার। যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাই সরকার চাইলেই এ ধারা বাতিল করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ