X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

রাজশাহীতে যেখানে-সেখানে ফিজিওথেরাপিস্ট, ওরা কারা?

উদিসা ইসলাম ও দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৫আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:১৮

উপশহর ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার কোরবানির পশুর মাংস কাটার কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ করে বসা অবস্থা থেকে উঠতে পারছিলেন না শরিফুল। চট করে হাতের কাছে পরিচিত এক ‘ফিজিওথেরাপিস্টের’ ফোন নম্বর নিয়ে কল করে তাকে বাসায় ডেকে আনা হয়। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও শরিফুলের উঠে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি সেই ‘থেরাপিস্ট’। এরপর একজন চিকিৎসক বাসায় এসে কিছু ব্যায়াম করিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে দাঁড় করান এই রোগীকে।

আগের ওই থেরাপিস্ট শরিফুলকে কী ধরনের এক্সারসাইজ করিয়েছেন শুনে চিকিৎসক বলেন, ‘ওসব ভুল ছিল। এই অসুবিধার জন্য সামনের দিকে একেবারেই ঝোঁকা যাবে না।’ অথচ থেরাপিস্ট তাকে সামনের দিকে ঝোঁকার ব্যায়াম করিয়ে গেছেন। চিকিৎসক বলেন, ‘এতে হিতে বিপরীত হতে পারতো।’
পপুলার ডায়াগনিস্ট সেন্টারের সুজন আল হাসান। টেনিস এলবো নিয়ে হাজির এক রোগীকে দেখে কোনও ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই স্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে হবে জানিয়ে দেন। একঘণ্টা পর তার ব্যক্তিগত ক্লিনিকের ঠিকানায় সেই রোগীকে যেতে বলেন। পরে সেখানে গেলে ইনজেকশনটি পুশ করার জন্য পৃথক চার্জ নেওয়া হয়। ইনজেকশন দেওয়ার সময় সহযোগী হিসেবে দু’জনকে রাখা হয়— বিষয়টি দেখে শেখার জন্য।
রাজশাহী ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার রোগীর তিন মাস আগে সিজার অপারেশন হয়েছে শুনে ফিজিওথেরাপিস্ট সুজন আল হাসান ওই রোগীকে পা ও কোমরের কয়েকটি ব্যায়াম শেখান। এরপর রোগীকে এই ব্যায়ামটি আরও কিছুক্ষণ করানোর মাধ্যমে সেটি শিখিয়ে দিতে সহযোগীদের নির্দেশ দেন। আর সপ্তাহে দু’দিন তাদের কাছে এসে থেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেন। এই দুই সহযোগীর সঙ্গে পরে যোগাযোগ করা হয়। তারা কোথা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছেন, জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সুজন আল হাসানকে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
রাজশাহীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে কেবল দেখে দেখে শেখা ‘থেরাপিস্টের’ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। টেলিফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে গিয়ে প্রতিবারে ৪০০ টাকা করে ফি নিয়ে থেরাপি দিচ্ছেন, এরকম থেরাপিস্টের সংখ্যা কত, তা জানাতে পারেনি কর্তপক্ষ। শহরজুড়ে নির্বিঘ্নে চলছে ভুয়া ফিজিওথেরাপিস্টদের রমরমা চিকিৎসা বাণিজ্য। এ নগরীতে মাত্র সাত জন রেজিস্টার্ড ফিজিওথেরাপিস্ট থাকলেও কার্যক্রম চলছে অর্ধশতাধিক সেন্টারে।
প্রশাসনের চোখের সামনে থেরাপি সেন্টার খোলা হচ্ছে, চালাতে না পেরে বন্ধ করে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানান রাজশাহী ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের ম্যানেজার শফিকুল আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ১৭ বছর ধরে কাজ করছি। একজন নারী ও একজন পুরুষ থেরাপিস্ট এখানে থেরাপি দিয়ে থাকেন।’ তিনি জানান, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সেন্টারগুলো আসলে রেজিস্টার্ড না। আবার নিজেরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে শেখেওনি। টাকার গরমে কিছু যন্ত্রপাতি কিনে সেন্টার খুলে বসছে। কিছুদিন খোলা রেখে যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শফিকুল আলম বলেন, ‘এসব সেন্টারে থেরাপি নিলে রোগীরা যেকোনও ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারেন।’ যারা কোনও নিয়ম না মেনে এ ধরনের সেন্টার খুলে বসেন, তাদের বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি।
ফিজিওফেরাপি সেন্টার

এরা আদৌ ফিজিওথেরাপিস্ট কিনা, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া দরকার বলে মনে করেন প্রবীণ হিতৈষী হাসপাতালের ইনস্টিটিউট অব জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের চিকিৎসক মহসিন কবীর লিমন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেখতে হবে এদের বিপিটি বেসিক ডিগ্রি আছে কিনা। যারা ডিপ্লোমা পাস থেরাপিস্ট, তারা ঢাকার বাইরে গিয়ে প্র্যাকটিস করছেন। এরা ঢাকায় প্র্যাকটিস করতে পারেন না।’ করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দরকার স্বতন্ত্র কাউন্সিল। সারাদেশে এখন এই চিকিৎসা ছড়িয়ে গেছে। রোগীদের বিশাল চাহিদা আছে। বিষয়টিকে এখন আইনি কাঠামোতে আনা দরকার। বাধ্যবাধকতা না থাকায় কারিগরি থেকে, আবার ডিপ্লোমা থেকে পাস করা, এমনকি চিকিৎসকদের লিফটম্যান কিছুদিন সঙ্গে থেকে কিছু ব্যায়াম শিখে নিজেদের ফিজিওথেরাপিস্ট পরিচয় দিচ্ছেন।’
রাজশাহীতে ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন পাঁচ থেকে ছয়জন, বাকিরা সবাই টেকনোলজিস্ট বলে উল্লেখ করেন থেরাপিস্ট আদম আব্দুল্লাহ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগীরা ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসককে থেরাপিস্ট বলে ভুল করে থাকেন। আবার রোগী ধরে রাখতে সেই চিকিৎসকরাও এই ভুল ভাঙান না।’ তিনি বলেন, ‘যারা ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক, তারা ফিজিওথেরাপি প্র্যাকটিস করতে পারেন না। কিন্তু তাদের কাছে আসা রোগীদের গোপনে তাদের পরিচালিত সেন্টারে পাঠান। সেখানে থেরাপি দেন টেকনোলজিস্টরা। এরা একেবারেই অবৈধ। থেরাপির বিষয়গুলো না জানার কারণে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিয়ে সাময়িক ব্যথা কমিয়ে দেওয়া হয়, সারা পৃথিবীতে এই ওষুধ এখন নিষিদ্ধ।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক গোপেন্দ্রনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি কেউ তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন, তবে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অভিযোগের অপেক্ষা না করে নিজেদের কোনও মনিটরিং ব্যবস্থা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত খোঁজ রাখি। হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বাইরে খুব বেশি থেরাপিস্ট আছে বলে আমাদের জানা নেই।’

আরও পড়ুন:


রাজশাহীতে অপরিচ্ছন্ন ক্লিনিকে খালি পায়ে ঢুকতে বাধ্য হন রোগীরা

 

/ইউআই/এপিএইচ/এমএমজে/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারি কর্মী ছাঁটাই সহজ করতে ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগ
সরকারি কর্মী ছাঁটাই সহজ করতে ট্রাম্পের নতুন উদ্যোগ
গণতন্ত্রের কোনও বিকল্প নাই: মির্জা ফখরুল
গণতন্ত্রের কোনও বিকল্প নাই: মির্জা ফখরুল
সংস্কার করতে আর কত সময় লাগবে আপনাদের, প্রশ্ন রিজভীর
সংস্কার করতে আর কত সময় লাগবে আপনাদের, প্রশ্ন রিজভীর
অফিস সময়ে সভার জন্য সম্মানী না নেওয়ার নির্দেশ
অফিস সময়ে সভার জন্য সম্মানী না নেওয়ার নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: বাংলাদেশকে আবারও সতর্ক করলো ভারত
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: বাংলাদেশকে আবারও সতর্ক করলো ভারত