পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহলের বাসিন্দা তোয়াছউদ্দিন। বয়স একশ পেরোলেও জীবনে কোনোদিন ভোট দেননি। ভোট কীভাবে দিতে হয় জানেনও না। এবারই প্রথম ভোট দেবেন তিনি। শতবর্ষী তোয়াছউদ্দিনের মতো জীবনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন পঞ্চগড় জেলার দুটি আসনের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের প্রায় ৯ হাজার নতুন বাংলাদেশি। দেশের মূল ভূখণ্ডে যুক্ত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়া এসব এলাকার নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। মূল ভূখণ্ডের নাগরিকদের মতো তারাও নির্বাচনি উৎসবে মেতে উঠেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে বলে ভোট দিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন তারা। নির্বাচনকে ঘিরে নানা প্রত্যাশাও রয়েছে নতুন বাংলাদেশিদের মধ্যে।
পঞ্চগড়-১ আসনের ৭টি ছিটমহলে ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ২৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫২৭ জন এবং নারী ভোটার ৪৯৮ জন। পঞ্চগড়-২ আসনের ২৯টি ছিটমহলে ভোটার সংখ্যা ৬ হাজার ২২০ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৩ হাজার ২৭৫ জন এবং নারী ভোটার ২ হাজার ৯৪৫ জন।
বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহলের শতবর্ষী আরেক ভোটার আফছার উদ্দিনউদ্দিন বলেন, ‘৬৮ বছর ধরে বাংলাদেশি এলাকার নির্বাচনে ভোটের দৃশ্য দেখে আসছি। কিন্তু আমরা ভোট দিতে পারিনি। সরকার আমাদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। কষ্ট হলেও ভোট দিতে যাবো।’
শালবাড়ি ছিটমহলের সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগে দেশও ছিল না, ভোটাধিকারও ছিল না। এখন নাগরিকত্ব পেলাম, শেষ বয়সে এসে ভোটারও হলাম। ছিটমহলে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। দলবদ্ধভাবে এবার আমরা প্রথমবার ভোট দেবো। ৭১ বছর পর ভোট দিতে পারবো। খুব ভালো লাগছে।’
গৃহবধূ মলি বেগম বলেন, ‘বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিবাসী হওয়ায় কোনও সুযোগ-সুবিধা পাইনি। এমনকি স্বাধীনভাবে যে চলাফেরা করবো সেটারও কোনও সুযোগ ছিল না। তিন বছর হলো আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমরা ভোটার হয়েছি, ভোট দিতে পারবো এজন্য আমরা খুবই খুশি। যে আমাদের এলাকার উন্নয়ন করবে সুখে দুঃখে পাশে থাকবে, অবহেলিত নারীদের কথা বলবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এমন প্রার্থীকে আমরা বেছে নেবো।’
পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার হাড়িভাসা ও হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিক লুৎফর রহমান (৮৫), মোশাররফ হোসেন (৯২) রহিমা বেগম (৭৫) বলেন, ‘আমরা ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে দিনক্ষণ গুনছি। শেষ বয়সে প্রথমবার ভোট দিতে যাবো আনন্দ লাগছে।’
বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ চাই, নিরাপদে ভোট দিতে চাই। ভোটকেন্দ্রে যেন কোনও গোণ্ডগোল না হয়। সুষ্ঠুভাবে যেন ভোটটা দিতে পারি এটাই আমাদের কামনা।’
শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা বিলুপ্ত ছিটমহলের ছাত্রছাত্রীরা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। এখনও পড়ছি। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করছি। বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থীদের জন্য যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন, যারা আমাদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারবেন এমন প্রার্থীকেই আমরা বেছে নেবো।’
পঞ্চগড় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘পঞ্চগড়-১ আসনে ৭টি এবং পঞ্চগড়-২ আসনে ২৯টি ছিটমহল রয়েছে। দুটি আসনের এসব ছিটমহলে মোট ভোটার ৮ হাজার ৯৩৫ জন ভোটার। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪ হাজার ৬৭৪ জন এবং নারী ভোটার ৪ হাজার ২৬১ জন। নতুন বাংলাদেশিরা এবারই প্রথম ভোট দেবেন। তাদের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।’
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পঞ্চগড় জেলায় যোগ হয় বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।