X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৫ বৈশাখ ১৪৩২

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি: ১২ বছরের মূল্যায়ন

একরামুল হক শামীম
০১ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৩০আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:১২

একরামুল হক শামীম মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্ব অর্পিত হয় বিচার বিভাগের ওপরে। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের এক যুগপূর্তি হলো। এ সময়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিরও একযুগ পূর্ণ হলো। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে স্বাগত জানিয়েছিল। জনগণের আস্থার প্রতি বিচার বিভাগের দায়ভার রয়েছে বিধায় এই এক যুগে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্যায়ন জরুরি। 
২০০৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্ব বিচার বিভাগের কাছে অর্পণের আগে মোট অনুমোদিত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সংখ্যা ছিল ৬৫৫টি। তবে বিচার বিভাগকে মাত্র ২১৮ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। ২০০৭ সালের শেষে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৮ হাজার ৬৭১টি। অর্থাৎ প্রায় ৬ লাখের কাছাকাছি মামলা নিয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি শুরু হয়। কিন্তু আগে ৬৫৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করলেও নভেম্বরের পর কাজ করে মাত্র ২১৮ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে শুরুতেই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ভীষণ প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। 

২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ১১৭ এবং বিচারাধীন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৪টি। সারাদেশের সিজেএম ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬ লাখ ৬৪ হাজার ০৬৩টি এবং সিএমএম ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৪০টি। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪০৩টি। (তথ্যসূত্র: ১ এপ্রিল ২০১৯ হতে ৩০ জুন ২০১৯  পর্যন্ত বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যানমূলক প্রতিবেদন, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।)

এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, দেশের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা অন্যান্য ফৌজদারি আদালত থেকে বেশি। এছাড়া, এটি মনে রাখতে হবে যে, বেশিরভাগ ফৌজদারি মামলা ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রস্তুত করে বিচারের জন্য এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে পাঠান। ফলে স্বীকার করতেই হবে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোর কাজের পরিমাণ অনেক বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেটদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু মামলার সংখ্যা বিবেচনায় সেই অনুপাতে ম্যাজিস্ট্রেট নেই।

২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সময় ৬৫৫টি ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃজন করা হয়। এরমধ্যে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ৬০০ জন এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ৫৫ জন (সিজেএম, সিএমএম, এসিজেএম, এসিএমএম পদও রয়েছে)। ২০০৭ সালের ১৯ আগস্ট প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) এই পদগুলো অনুমোদন করে। ২০০৭ সালের শেষে ম্যাজিস্ট্রেট প্রতি মামলার অনুপাত ছিল ১:৯৪৫। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে অনুমোদিত ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ৬২০ জন এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে অনুমোদিত ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ৬৬ জন। সর্বমোট ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ৬৮৬ জন। তবে ৬৮৬টি অনুমোদিত পদ থাকলেও বিচারক স্বল্পতার কারণে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা অনুমোদিত পদের চেয়ে কম। ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটপ্রতি মামলার অনুপাত ১: ১৩৬৫। কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বিবেচনা করলে এই অনুপাত আরও বাড়বে।  মামলা বাড়লেও সেই অনুপাতে ম্যাজিস্ট্রেটের পদসংখ্যা বাড়ানো হয়নি।

ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত হলেও মামলা নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান থেকেই কাজের পরিমাণ বিবেচনা করা সম্ভব হবে। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টগুলোতে মামলা দায়ের হয়েছে ৮৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৮টি। এ সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৫ লাখ ৪৪ হাজার ৮২২টি। (দায়ের অংশে পুনরজ্জীবিত মামলাগুলো যুক্ত রয়েছে এবং সব নিষ্পত্তি একত্রে দেখানো হয়েছে) (তথ্যসূত্র: ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশের মামলার পরিসংখ্যানমূলক প্রতিবেদন, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট) ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টগুলোর মামলার নিষ্পত্তির হার ৯৬.৫৮%। ২০০৮ সালে ম্যাজিস্ট্রেসির নিষ্পত্তির হার ৮৬.৮৮%, ২০০৯ সালে ৯৩.৭৪%, ২০১০ সালে ১০৩%, ২০১১ সালে ৯৫.১২%, ২০১২ সালে ৯০.৬৫%, ২০১৩ সালে ৮৮.১৩%, ২০১৪ সালে ৯২.৬৭%, ২০১৫ সালে ১০৯%, ২০১৬ সালে ১০৬.৬৬%, ২০১৭ সালে ১০২.৬৯%, ২০১৮ সালে ৯২.৯৮% এবং ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত নিষ্পত্তির হার ৯৫.৯৯%।

উল্লেখ্য, মামলা বিচারের পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টগুলোকে মামলা গ্রহণ, জামিন শুনানি, পিটিশন শুনানি, সিএস/এফআর শুনানি, নারাজি শুনানিসহ অন্যান্য কাজ করতে হয়।  

পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে, গত ১২ বছরে ম্যাজিস্ট্রেটের পদের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৩১টি! ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাদেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২ এবং থানার সংখ্যা ৬৪৪টি। ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে উপজেলার সংখ্যা বেড়েছে ৮টি এবং থানার সংখ্যা বেড়েছে ৪৫টি।  ‘নতুন উপজেলা, থানা এবং তদন্তকেন্দ্র স্থাপনের সংশোধিত নীতিমালা, ২০১৪' অনুযায়ী নতুন উপজেলা/থানা প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে আবশ্যিকভাবে কিছু পদ সৃষ্টির প্রস্তাব থাকে। কিন্তু নতুন ম্যাজিস্ট্রেট পদ তৈরি করা হয় না। নতুন উপজেলা/থানা প্রতিষ্ঠা করা হলেই সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃষ্টি করা জরুরি। এছাড়া, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট সৃজনে সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা হলো মামলার সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান মামলার সংখ্যা বিবেচনায় ম্যাজিস্ট্রেট পদের সংখ্যা বাড়ানো আবশ্যক। ৩৪৬টি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়। এই পদগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সৃষ্টি করা হলে ম্যাজিস্ট্রেসি কাঙ্ক্ষিত গতি পাবে, উপকৃত হবে বিচারপ্রার্থী জনগণ। 

বেশ কিছু আইনের অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান থাকলেও সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ এর ৫ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর ৬৪ ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ এর ৮ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় এক বা একাধিক দ্রুত বিচার আদালত গঠনের বিধান রয়েছে। বন আইন, ১৯২৭ এর ৬৭ক ধারা অনুযায়ী বন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বর্তমানে জেলার কোনও একজন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব আদালতে পৃথক স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হলে মামলার নিষ্পত্তি নিঃসন্দেহে বাড়তো। একইসঙ্গে কাজের মানও বাড়তো। 

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারাদেশের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোর জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ২৭৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ম্যাজিস্ট্রেসিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই। 

২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসির মামলার সংখ্যা বেড়েছে ৩ লাখের মতো। পরিসংখ্যান বিবেচনায় যে কেউ এটি বলতেই পারেন, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে । তবে এক্ষেত্রে মামলা দায়েরের পরিমাণও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মোট মামলা দায়ের ও পুনর্জীবিত হয়েছে ৮৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৮টি। এসব পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়েই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসির সফলতা ও ব্যর্থতার হিসাব করা প্রয়োজন। 

লেখক: বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত

 

/এপিএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৮০ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে শীর্ষ দুইয়ে ব্রিটিশ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা আনিসা
৮০ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে শীর্ষ দুইয়ে ব্রিটিশ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা আনিসা
থানায় ওসির টাকা নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল
থানায় ওসির টাকা নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল
সংস্কারের পর নির্বাচনের দাবিতে ‘মার্চ ফর ড. ইউনূস’ কর্মসূচি
সংস্কারের পর নির্বাচনের দাবিতে ‘মার্চ ফর ড. ইউনূস’ কর্মসূচি
বৃষ্টিভেজা ম্যাচে বেঙ্গালুরুকে উড়িয়ে দিলো পাঞ্জাব
বৃষ্টিভেজা ম্যাচে বেঙ্গালুরুকে উড়িয়ে দিলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক