X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

আজ থেকে স্বাধীনতা শব্দটি সবার

প্রভাষ আমিন
০২ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:০০আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৭, ২২:৩৯

প্রভাষ আমিন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা অর্জন বাংলাদেশকে গর্বিত করেছে। একসময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ মানেই ছিল নেতিবাচক খবর। ঝড়-বন্যা-সাইক্লোন মিলিয়েই বাংলাদেশকে চিনতো সবাই। বিদেশিরা বাংলাদেশিদের দিকে তাকাতো করুণার দৃষ্টিতে, সহানুভূতির চোখে। সেদিন গত হয়েছে বহু আগে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। খেলা, অর্থনীতিসহ নানা সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়ন চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। এ অর্জনের ধারায় সব শেষেরটি সবচেয়ে গৌরবের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তখনকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এখন ঐতিহাসিক দলিল, বিশ্বের সম্পদ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো এই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতি এবারই প্রথম নয়। ৭ মার্চের সেই ভাষণ সবাইকে আন্দোলিত করেছে। স্বাধীনতার পক্ষের সবাই যেমন উজ্জীবিত হয়েছেন, তেমনি স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালি এবং পাকিস্তানি শাসকরা আতঙ্কিত হয়েছিলেন। তখনই তারা বুঝে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপারমাত্র। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড গত আড়াই হাজার বছরের সেরা ভাষণ নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাতেও ঠাঁই পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ।

বঙ্গবন্ধু যখন এই ভাষণটি দেন, তখন আমি বছর দুয়েকের শিশু। কিন্তু পরে কয়েক হাজারবার ভাষণটি শুনেছি। যতবার শুনেছি, ততবার উজ্জীবিত হয়েছি দেশপ্রেমে। কবি নির্মলেন্দু গুণ সেই বিকেলের ছবি এঁকেছেন কবিতায়:

সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান,– এসবের কিছুই ছিল না,

শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত

ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।

আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল

এই ধু ধু মাঠের সবুজে।

কারা এসেছিলেন সেদিনের সেই সমাবেশে? এই প্রশ্নের উত্তরও লেখা আছে নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়–

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে

এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,

লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,

পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।

হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,

নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে

আর তোমাদের মতো শিশু পাতা- কুড়ানীরা দল বেঁধে।

সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর আসা, তার আগের সময়কার অনেক বর্ণনা আছে ইতিহাসে। তবে গুণদার মতো করে আর কে বোঝাতে পেরেছিলেন সেই সময়কার ছবিটি? আবারও নির্মলেন্দু গুণের কাছে হাত পাতি–

একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল

প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জন সমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

বঙ্গবন্ধু কবি নন, একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু ৭ মার্চের সেই বিকেলে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন শ্রেষ্ঠ এক কবি। মাত্র ১৮ মিনিটের একটি স্বতস্ফূর্ত ভাষণে কিভাবে একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধারণ করা যায়, তার অনন্য এক দলিল এই ভাষণ।

এখন যখন আমরা ভাষণটি শুনি, মনে হতে পারে, এ আর এমন কী? কিন্তু ভাবুন একবার সেই ৭ মার্চের কথা। ৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কেউ পাকিস্তান শাসন করবে, এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না পশ্চিমাদের পক্ষে। চলছিল নানা ষড়যন্ত্র, টালবাহানা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। সবাই আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু ১ মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুসে ওঠে জনতা। বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। জনতার দাবি, ছাত্রনেতাদের চাপ, সিনিয়র নেতাদের ভিন্নমত,  সবমিলিয়ে বঙ্গবন্ধু তখন চিড়ে-চ্যাপ্টা। বেগম মুজিব বলে দিলেন, তোমার হৃদয় যা বলবে, তুমি তাই বলবে। বঙ্গবন্ধুর জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল জনতার আবেগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু তাতে কী হতো? হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়তো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিনই রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে পারতো রেসকোর্স ময়দানে। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আসা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম বিশ্বে পরিচিতি পেতে পারতো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু হয়ে যেতে পারতেন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। আবার স্বাধীনতার কথা বলা ছাড়া সেদিনের রেসকোর্সের লাখো মানুষকে ঘরে ফেরানো কঠিন ছিল। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বুদ্ধিমত্তার কী অসাধারণ প্রয়োগ! সবই বলে দিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের উপায় ছিল না তাকে ধরার। অপরিণত সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী হয়, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন কাতালনিয়ার স্বাধীনতাকামী নেতা পুজেমন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তাকে এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কিন্তু শত উস্কানির পরও বঙ্গবন্ধু দারুণ সংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন। আসলে তখন একটা দারুণ কৌশলের খেলা চলছিল। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করছিল পশ্চিমারা। চলছিল অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের জন্য। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান হলো হামলাকারী আর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু হলেন স্বাধীনতাকামী নেতা।

মাত্র ১৮ মিনিটে এক হাজার ৮৬ শব্দে একটি জাতির ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস ধারণ করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করা- কল্পনাকেও হার মানায়। কোনও লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া এমন একটি মহাকাব্য লেখা সম্ভব? শুনলে মনে হবে, একটুও মেদ নেই, একটিও বাড়তি শব্দ নেই। অথচ কোনও না বলা কথা নেই। সব দাবি উঠে এসেছে নিপুণভাবে, সব আবেগ উঠে এসেছে দারুণভাবে। দাবি আছে, হুমকি আছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন হৃদয় থেকে, কিন্তু তাতে বিবেচনার অসাধারণ মিশেল।

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে মজার গল্প বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন এক বিদেশি সাংবাদিকের দোভাষী হিসেবে। সেই সুবাদে মঞ্চের খুব কাছে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ভাষণের শুরুতে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুবাদ করার চেষ্টা করলে সেই সাংবাদিক তাকে ইশারায় থামিয়ে দেন। পরে সেই সাংবাদিক তাকে বলেছেন, অনুবাদ করার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু কী বলেছেন, তা হয়তো বোঝেননি সেই সাংবাদিক। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আবেগটা ধরতে তার কোনোই অসুবিধা হয়নি।

যতবার এই ভাষণটি আমি শুনি, ততবারই আমি কিছু না কিছু শিখি। যেমন বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শুনে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গেছে। আমি এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র নয়, ন্যায্যতার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আর ন্যায্যতার গণতন্ত্রের শেষ কথা মানি বঙ্গবন্ধুর ভাষণকেই ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ যদিও সেই ন্যায্যতার গণতন্ত্রের ধারণা থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক দূরে। ন্যায্যতা নয়, এখন চারপাশে এখন শুধু প্রতিহিংসা।

নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতা শেষ করেছিলেন, ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর এখন বলাই যায়, ‘আজ থেকে স্বাধীনতা শব্দাটি সবার।’

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

এসএএস/ এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
চাঁদপুরে ভিমরুলের কামড়ে একজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩
সারা দেশে বৃষ্টির আভাস
সারা দেশে বৃষ্টির আভাস
সারা দেশে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ আজ
সারা দেশে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের মহাসমাবেশ আজ
নারায়ণগঞ্জে ঝুটবোঝাই চলন্ত ট্রাকে আগুন, চালক আহত
নারায়ণগঞ্জে ঝুটবোঝাই চলন্ত ট্রাকে আগুন, চালক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক