ভিন্ন অঙ্গনের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের রাজনীতিতে আসা নতুন কোনও গল্প নয়। তবে ভিন্ন পথে হাঁটা মানুষও আছেন। শুধু রাজনীতি নয়, মন্ত্রিত্বের আসন ছেড়ে দেন তিনি। ২০১২ সালে তিনি বলেছিলেন, সক্রিয় রাজনীতিতে আর ফিরবেন না। তবে এটাও বলেছিলেন, দেশের মানুষে পাশে ফিরবেন হয়তো অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনও পথে। মাদককে না বলে, ফিটনেসকে হ্যাঁ বলার আহ্বান জানিয়ে তিনি ফিরে আসার সেই কথা রেখেছেন। দেশের মানুষকে শরীরচর্চায় আগ্রহী করে তোলার কাজে নেমেছেন। বলা হচ্ছে তানজিম আহেমদ সোহেলের কথা, যিনি সোহেল তাজ নামেই খ্যাত।
ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের ৭৫১ ভবনের সামনে পুরনো বড় একটি আম গাছ। যেটি লাগিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। সেখানেই ছিল একটি তিন তলা বাড়ি, যেখানে তাজউদ্দিন আহমেদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেন। সোহেল তাজের ছোটবেলা কেটেছে এই বাড়িতেই। তবে সেখানে আগের বাড়িটি আর নেই, করা হয়েছে বহুতল ভবন। সেই ভবনের সামনে বড় সাইনবোর্ড, যেখানে লেখা ‘ইনস্পায়ার ফিটনেস বাই সোহেল তাজ’। ভবনটির আট তলায় এই ব্যায়ামাগার, যেটি সোহেল তাজ নিজেই পরিচালনা করেন।
২০২০ সালে করোনা মহামারিতে যখন দেশের ব্যায়ামাগারগুলো বন্ধ, তখন ১৫ অক্টোবর চালু হয় ‘ইনস্পায়ার ফিটনেস বাই সোহেল তাজ’। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন মানুষ এই ব্যায়ামাগারের সদস্য, তারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন এখানে। ১৩ বছরে বয়সী কিশোর যেমন আসেন এখানে, তেমনি ৭২ বছর বয়সী মানুষও শরীরচর্চা করছেন সোহেল তাজের তত্ত্বাবধানে।
করোনা মহামারিতে সংক্রমণ রোধের বিষয়টিতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন সোহল তাজ। জানালেন, চালু হওয়ার পর থেকে এই ব্যায়ামাগারের কোনও সদস্য করোনা আক্রান্ত হননি।
ব্যায়মাগারের প্রবেশ মুখে প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এরপর স্যানিটাইজার দেওয়া হয় হাত জীবাণুমুক্ত করতে। অতিথিদের প্রবেশের জন্য দেওয়া হয় শু ক্যাপ, যাতে জুতোর মাধ্যমে কোনও জীবাণু না ছড়ায়।
ব্যায়ামাগারের ভেতরে প্রবেশ করতেই মাস্ক খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে বলেন সোহেল তাজ। নিঃশ্বাস নেওয়ার পর মনে হবে না কোনও বন্ধ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে আছেন। সোহেল তাজ জানালেন, অন্য আর দশটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মতো পদ্ধতি এখানে ব্যবহার হয়নি। সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় রুমের বাতাস টেনে নিয়ে আবার সার্কুলেটেড করা হয়। কিন্তু এখানে পদ্ধতিটি ভিন্ন। বাইরের বিশুদ্ধ বাতাস টেনে ভেতরে ছাড়া হয়, আর বাতাস ছাড়ার মুখে বসানো হয়েছে আল্ট্রাভায়োলেট সি (ইউভিসি) লাইট। বাতাসে যদি কোনও জীবাণু বা ভাইরাস থাকে তাহলে অতিবেগুনী রশ্মি তা মেরে ফেলবে। অন্য দিকে রুমের বাতাস বের করে দিতে আছে আলাদা একজস্টিং ব্যবস্থা।
সুস্থ থাকার জন্য শরীরচর্চা জরুরি, আর এর জন্য বয়স কোনও ব্যাপার নয় তার প্রমাণ সোহেল তাজ নিজেই। ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই মানুষ নিজের ফিটনেস দিয়ে প্রমাণ করেছেন ফিট থাকার ইচ্ছেই আসল। খাদ্যাভ্যাস, সঠিক জীবনযাত্রা, শরীরচর্চা থাকলে যে কোনও মানুষই ফিট থাকবেন, বলছিলেন সোহেল তাজ। তিনি বলেন, ‘আপনি হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, হাসপাতালে ভর্তি হবেন, আপনার পরিবার আপনার জন্য টাকা খরচ করবে। আর যদি হুট করে মারা যান, তাহলে পরিবার আপনাকে যেমন হারাবে, আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরচেয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা কি ভালো নয়?’
উদাহরণ দিয়ে সোহেল তাজ বলেন, ‘সারওয়ার নামে একটা ছেলে এখানে ব্যায়াম করে তিন মাস ধরে। তার ওজন ছিল ১১৪ কিলোগ্রাম। তিন মাসে সে ২২ কেজি ওজন কমিয়েছে। মারাত্মক ওভারওয়েট অবস্থা থেকে সে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসতে পেরেছে। তার কনফিন্ডেন্ট লেভেলও বেড়েছে।’
ব্যায়ামাগারে আধুনিক মান সম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কোনও কার্পণ্য করেননি সোহেল তাজ। জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ভারটেক্সের তৈরি ব্যায়ামের যন্ত্রাপাতি ব্যবহারের কথা। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এমন আধুনিক ব্যায়ামাগার তৈরির স্বপ্নের কথা বললেন তিনি। ব্যায়ামাগারে প্রতিটি সদস্যকে নিজেই প্রশিক্ষণ দেন সোহেল তাজে। সঙ্গে আছেন আরও প্রশিক্ষক।
তিন মাস ধরে এই ব্যায়ামাগারে আসে আনিক সাকিব। ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এই ছাত্রের শরীরচর্চা শুরু সোহেল তাজের হাত ধরেই। অনিক সাকিব জানায়, ‘আমি তিন মাস ধরে এখানে আসছি। বুঝতে পারছি আমার ভেতরে পরিবর্তন আসছে, মাসল গ্রো হচ্ছে। আমি চাই সব সময় ফিট থাকতে, কোনোভাবেই আনফিট হতে চাই না। আর স্যার (সোহেল তাজ) আমাদের খুবই অনুপ্রেরণা দেন, তাতে আমি আরও উৎসাহ বোধ করি।’
শুধু অন্যদের প্রশিক্ষণ নয়, নিজেও শরীরচর্চার নমুনা দেখিয়ে চমকে দিয়েছেন সোহেল তাজ। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বুঝতে ভুল করেন, ফিটনেস আর বডি ব্লিল্ডিং কিন্তু এক না। আমি কিন্তু বডি ব্লিল্ডিং করছি না, নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে ব্যায়াম করছি।’
ব্যায়ামের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ বলে জানালেন সোহেল তাজ। তিনি নিজেই ব্যায়ামাগারের সদস্যদের ডায়েট চার্ট প্ল্যান ঠিক করে দেন। সোহেল তাজ বলেন, ‘শরীরের ওজন কমাতে হবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে। জেনে বুঝে না করলে কোনও সুফল আসবে না, উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।’
সারাদেশে শরীরচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে চান সোহেল তাজ বললেন, ‘গ্রামের মানুষ পরিশ্রম করে এখনও। কিন্তু যারা শহরে থাকেন তারা পরিশ্রম করেন না। যার ফলে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভোগেন। এসব দূর করা সম্ভব শরীরচর্চার মাধ্যমে। বয়স ৮০ কিংবা ৯০ হোক, আপনি যদি ব্যায়াম করেন, শরীর ফিট থাকে, তবে আপনি তারুণ্যের শক্তি পাবেন।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম
আরও পড়ুন- সোহেল তাজের শরীরচর্চা কেন্দ্রে বন্ধু কাজী নাবিল আহমেদ